যদি আপনার কল্পিত কথিকা হয় নির্দিষ্ট সময়কালে আবর্তিত, তবে শ্রোতাকেও নিয়ে যেতে হবে অতীত পরিমন্ডলে যখন ঘটনাটি ঘটেছিল। যদি আপনার সৃষ্টিকে বর্তমানে বার্তাবহ করতে হয় তবে কালজ উপল ঠেলে বাঁকাতে হবে কথিকার গতিমুখ। তবে, স্থান–কাল পরিমাপে নতুন মাত্রা যুক্ত হবে। কিন্তু তা হয়নি ‘ইকুয়েসনস্’ নাটকে।
আকর কথিকাটি লেখা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ঠান্ডা যুদ্ধের পটে, যখন নাজী চিন্তা সম্পূর্ণ নির্বিষ হয়নি। এই অসাধারণ গল্পটির কথাশিল্পী আনাতোলি ডিপ্রভ। এই গল্পকে যে নাটকে রূপ দেওয়া সম্ভব, তা প্রমাণ করেছেন নাটককার তীর্থঙ্কর চন্দ্র। সাধুবাদ।রাজা ভট্টাচার্য্যকে অভিনন্দন এই আপাত অসম্ভব নাটকটিকে পাঠিত স্তর থেকে গঠিত স্তরে তুলে আনার সৎ সাহসে। কিন্তু সব মিলে ‘ইকুয়েসনস্’ কি সমাধান পেল?
Kaahon Theatre Review
BUKJHIM EK BHALOBASHA – A NOVEL ENACTED
Read more : https://t.co/vsNnhOEQVK#bengalitheatre |#kaahontheatrereview pic.twitter.com/uDc4PXvKV2— kaahon (@kaahonwall) July 15, 2017
একজন তাত্বিক পদার্থবিদ (অভিনয়ে দেবশঙ্কর হালদার) ম্যাক্সওয়েলের জটিল সমীকরণের দ্রুত সমাধানের উপায় খুঁজছিলেন।তিনি বিজ্ঞাপন দেখে নব আবিষ্কৃত কম্পিউটার চালনাকারী একটি দলের শরণাপন্ন হলেন। যে জটিল সমীকরণের সমাধানে যন্ত্রেরও বহুদিন লাগার কথা তা তিনি সেই সেন্টার থেকে একদিনেই পেয়ে গেলেন। তিনি আরো জটিল সমীকরণ দিলেন, এবং দ্রুত উত্তর পেলেন। এবার তিনি সমাধানগুলি খুঁটিয়ে পরীক্ষা করলেন এবং লক্ষ করলেন এই সমাধান কোন ছাঁচে মিলছে না। সমীকরণের বিভিন্ন অংশ বিভিন্ন প্রথায় করা হয়েছে। তিনি নিশ্চিত হলেন যে এ কাজ কোন যন্ত্রের পক্ষে করা সম্ভব নয়, এবং একমাত্র মানুষের মেধা, বিভিন্ন প্রথার সাহায্য নিতে পারে। প্রবল অনুসন্ধানে তিনি জানলেন যে একজন নাজী যুদ্ধাপরাধী সাধারণ মানুষের মস্তিস্কে তড়িৎ-চুম্বকীয় রশ্মি পাঠিয়ে কৃত্রিম উপায় অতি সক্রিয় করে অংকগুলির সমাধান করাচ্ছেন। সেই মগজকে ইচ্ছামত চালিত করার উপায়কেই কাজে লাগিয়ে, এই পদার্থবিদ, সেই চক্রান্তের অবসান ঘটান। মানব মগজকে যন্ত্রানুরূপ মেধা সম্পন্ন করার প্রক্রিয়াকে ঘিরে রহস্য ঘনীভূত হয় এই নাটকে।
কিন্তু আলোচ্য নাটকে দর্শক ঠান্ডাযুদ্ধের গতিশীল রাজনৈতিক রোমাঞ্চ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। গল্পটির সময়কাল ও উদ্দেশ্য বোঝাবার জন্য ভূমিকা ও পরিপ্রেক্ষিতের অবশ্যই প্রয়োজন আছে কিন্তু অতিব্যাখ্যা, অতিকথনে নাটক কুব্জ, শ্লথপ্রায়। নাজীচিন্তা ঘৃণিত শুধু যুদ্ধের বীভৎসতায় নয়, অগণন গণহত্যায় নয়, বরং মেধাসম্পন্ন মানুষের অধীত সৃজনশীলতাকে ছাঁচে ঢেলে দিয়ে আরও প্রফিট-প্রসবা করে তোলায়। আজকের পৃথিবীতে এ কথা প্রাসঙ্গিক। বর্তমান শিক্ষাব্যাবস্থা লাভমুখী মনন গড়ে তোলার প্রক্রিয়া হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই শিক্ষাব্যাবস্থা স্বাধীন চিন্তা, স্বাধীন মননের কোন অবকাশ রাখে না। বোধহীন আনুগত্যই কাম্য। এ হেন পরিপ্রেক্ষিতে এ নাটকটি যথার্থ হতে পারত, যদি সেভাবে, এই সময়টিকে ধরে গল্পটিকে বলা হত।
সঠিক ভাবেই নাটকটির ভারতীয়করণ করা হয়নি। আবার ষাটোর্দ্ধ জার্মানীর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট চিত্রায়ন করতে ব্যর্থ এই নাটক। অতএব, এই সময় বসে কোন স্থান এবং কালকে ধরে, দর্শক নাটকের কথিকাকে প্রতিস্থাপন করবে, এই দ্যোতনা তাদের মনে রয়েই যায়। শুধু নাম ছাড়া, দু’একজনের পোষাক ছাড়া জার্মানী কোথায়? ভাষা বাংলা, কিন্তু হাবভাব, চলন, মুদ্রাদোষ, কথন জার্মান হতে পারত। তাতে অন্তত ঠান্ডা যুদ্ধের নির্মম সময়কে ধরা যেত। অপ্রয়োজনীয় উপঘটনা, রিলিফ উদ্দেশ্যহীন ভাবে নাটকে ব্যবহার করে নির্দেশক দর্শকদের একটি থ্রিলার দেখার উত্তেজনা থেকে বঞ্চিত করলেন। নাটকটি না হল বর্তমান শিক্ষাব্যাবস্থার যোগ্য প্রতিলিপি, না হল প্রকৃত রূপক।
দর্শক রোমাঞ্চিত হয়েছেন একমাত্র সঙ্গীতে। যথাযথ প্রয়োগ। এই নাটকটির মেজাজ ঠিক ধরেছেন দ্রোণ আচার্য। সাধুবাদ। কিন্তু সেই রোমাঞ্চ মাঝে মাঝেই ফিকে করে দিয়েছে ফটফটে ফ্লাড লাইট। বর্ধিত প্রসেনিয়াম, যা রাজা ভট্টাচার্য্য ব্যবহার করেছেন এই নাটকে তা শুধুমাত্র অলংকরণ হিসেবেই থেকে গিয়েছে। যদি বর্ধিত বা অতি প্রসেনিয়াম সুব্যবহৃত হত, তবে চরিত্রগুলির অভিজ্ঞান আরো সুদৃঢ় হত।
পরিশেষে বলি, এ নাটকের কাহিনী বিন্যাস কোন স্বকীয় ফর্মের পরীক্ষা নিরীক্ষার অবকাশ দেয় না। বরং এই নাটকের কাহিনী সুচারু ভাবে কাহিনীর কথকতাকে দৃশ্যায়নের অধিকার দেয় মাত্র। নাট্যনির্মানের নেপথ্যে মঞ্চকার, সজ্জাকার, আলোক শিল্পী এবং সমক্ষে কুশীলবগণ প্রত্যেকেই অতীব গুণীজন। কিন্তু তাঁদের গুণপনা প্রকাশিত হল কই? অতি ব্যাখ্যা অত্যধিক বুঝিয়ে দেওয়া দেখে মনে হয় পরিচালক দর্শকদের মেধা ও কল্পনা শক্তির উপর যথেষ্ট আস্থা রাখতে পারেননি। ‘ইকুয়েসনস্’ নাটকটি সেকারণেই একটি মহৎ সৎসাহসের অসফল অভিজ্ঞান হয়ে রইল।
শ্রীজয়ী ভট্টাচার্য