নয়ে নাটুয়ার হালের উপস্থাপনা মৈমনসিংহ গীতিকা নিয়ে লিখতে বসেই যে সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় তা একটু উদ্ভট। তার কারণ, নামে এটি দলীয় একটি প্রযোজনা হলেও কার্যক্ষেত্রে এটি হয়ে উঠেছে একটি একক উপস্থাপনা। প্রযোজনা পুস্তিকা বলছে গৌতম হালদার দায়িত্ব নিয়েছেন নাট্যরূপ, সঙ্গীত, নৃত্যসৃজন, মঞ্চভাবনা, আলোকভাবনা ও নির্দেশনা, এসব কিছুরই। পুস্তিকা আরো জানাচ্ছে, তুলনামূলক ভাবে বড় হরফে, যে অভিনয়েও আছেন গৌতম (অভিনেতা হিসেবে বড় হরফে নাম ছাপার যোগ্য ধরা হয়েছে কেবল আরেক জনকে – দ্যুতি ঘোষ হালদার, যিনি পোশাক পরিকল্পনার বাড়তি দায়িত্বও পালন করেছেন)। এতো গেল পুস্তিকার কথা। পারফরম্যান্সের কথায় এলে তো কথাই ফুরিয়ে যায়, কারণ তার পুরোটা জুড়েই বিরাজ করেন গৌতম, গৌতম এবং শুধুই গৌতম। না, অন্য অনেকেই আছেন মঞ্চে, তবে তাদের থাকাটা গৌতমের থাকার পাশে এতটাই ম্লান যে নাটক চলাকালীনই মাঝে মাঝে প্রশ্ন জাগে গৌতম এই উপস্থাপনাটিকে কি আরেকটি মেঘনাদবধ কাব্য-র আদল দিতে চেয়েছেন, আবার চানওনি? তাই রিভিউয়ার বিভ্রান্ত, জব্দ – একটি নাটক, দলের অনেকে মিলে করা অথচ আদতে একা করা এবং সেই পারফরম্যান্সের পর্যালোচনা করার বিচিত্র সমস্যা নিয়ে।
বিজয় তেন্দুলকার সখারাম বাইন্ডার-এ প্রশ্ন তোলেন ভারতবর্ষের সমাজবদ্ধ জীবন যাপনের অন্ধকার দিককে আক্রমণ করে : https://t.co/yFj63rvd4p pic.twitter.com/wpgWBZqoJ2
— kaahon (@kaahonwall) May 11, 2017
আলোচনা শুরু হোক মূল নাটক শুরুরও আগের নাট্যাংশ নিয়ে যেখানে দর্শকরা লাইনে দাঁড়ানো হলের ভেতর ঢোকার জন্য আর তাঁদের সামনে উপস্থিত হন গৌতম ও আরো কয়েকজন পুরোপুরি প্রসাধনে ও পরিধানে সজ্জিত হয়ে। অভিনেতাদের কারো হাতে জ্বলন্ত ধূপ, কারো হাতে ঝুড়ি, তাঁরা অত্যন্ত বিনীত ভাবে স্বাগত জানান দর্শকদের, আপ্যায়ন করেন মুড়িবাতাসা প্রসাদ খাইয়ে। গৌতম কিছুটা অধিকারীর, কিছুটা কথক ঠাকুরের ভঙ্গিতে করজোড়ে জনেজনে গান শোনার জন্য অনুরোধ করেন, শুনতে আসার জন্যে বিনম্র ধন্যবাদ জানান। দর্শকদের কেউ কেউ চট করে ধরে ফেলেন পারফরম্যান্স শুরু হয়ে গেছে; কেউ কেউ আবার ব্যাপারটা ঠিক কি হচ্ছে তা ঠাহর না করতে পারলেও মাটিতে নেমে আসা মঞ্চের তারকার সাথে জমাতে চান হাল্কা আলাপ, তুলতে থাকেন সগৌতম সেল্ফি। হলে ঢোকার পর সবাই যখন আসন গ্রহণ করতে শুরু করেছেন, নাটক শুরু হতে কিছু সময় বাকি আর পর্দা সরানো মঞ্চে যখন দেখা যাচ্ছে একটা গ্রামের দৃশ্য, তখনো গৌতম করে যান অভ্যর্থনাকারীর পার্ট, দর্শকদের মধ্যে মিশে। কিন্তু বিধি বাম – এত কাছ থেকে ওনাকে পেয়ে এক জন মহিলা ভক্ত গৌতমের সাথে ছবি তুলতে বদ্ধ পরিকর হয়ে পড়েন। যে কয়েক মিনিট গৌতমের লেগে যায় পারফর্ম করতে করতেই ছবির প্রতিজ্ঞায় অটল ওই মহিলাকে নিরস্ত করতে, সেই সময়ে আমরা আলোচনা করে নিতে পারি শহরের বুকে একটা প্রাচীন, গ্রামীণ লোকায়ত শিল্প পরিবেশনার ও তার পরিমন্ডল সৃষ্টির চেষ্টার সমস্যাগুলো নিয়ে।
মৈমনসিংহ গীতিকা জন্ম দিয়েছে যে ভৌগোলিক, আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক ভিত্তিভূমি ও সময়কাল, তার থেকে দু’হাজার সতেরোর কলকাতার দূরত্ব তথা বিচ্ছিন্নতা অনতিক্রম্য। কারো কারো স্মৃতিতে ওই ফেলে আসা স্থান-কালের একটা ঝাপসা হয়ে আসা অবয়ব থাকলেও থাকতে পারে, অনেকের সেটুকুও নেই, কিন্তু আমাদের কারোরই বর্তমানের জীবনচর্চায় ও যাপনে ওই জীবনের কোনো চিহ্নই নেই। তাই গৌতমরা চাইলেও আমরা গীতিকার সেই দর্শক হতে পারিনা যে জানে অনুষ্ঠান শুরুর আগে পূজো, প্রসাদ বিতরণ, আপ্যায়ন সবটাই মূল অনুষ্ঠানের সাথে যুক্ত অর্থপূর্ণ রিচ্যুয়াল। তাই প্রসাদ আমাদের অবাক করে, শহুরে স্মার্টনেস দিয়ে আমরা আমাদের বিস্ময় বোধ কাটিয়ে ঝটাপট সেল্ফি তুলি, ছবির আব্দার করি, খোশ গল্প জুড়ি। যারা বুঝি কি হচ্ছে তাদের অবস্থা হয় আরো করুণ, কারণ আমরা নিজেদের যাপন দিয়ে ওই রিচ্যুয়ালে প্রবেশ করতে পারিনা, দাঁড়িয়ে থাকি দেঁতো হাসি হেসে; গায়েন এবং শ্রোতা এই অভিজ্ঞতায় সমান ভাবে না থাকায় রিচ্যুয়ালই হয়ে যায় অর্থহীন, নিষ্প্রাণ। তবে এটা ভাবার কোনো কারণ নেই লোকায়ত শিল্প পরিবেশনার ক্ষেত্রে সমস্যা সৃষ্টি করেন শুধু দর্শক। নয়ে নাটুয়ার হয়ে গ্রাম জীবনের যে দৃশ্য কল্প সৃষ্টি করেন গৌতম ও দ্যুতি (আমি এখানে বলছি মূলত আলো এবং পোশাকের কথা) তাতো আসলে আমাদের শহুরে কল্পনায় থাকা নয়নাভিরাম গ্রামের ছবি, যেখানে দারিদ্র্যটা ও ‘ডিজাইনার’। এটা পরিস্কার যে আলো এবং পোশাকের বণার্ঢ্য, ঝলমলে পরিকল্পনার পেছনে এই ভাবনা কাজ করেছে যে বাণিজ্যিক সিনেমার সংস্কৃতিতে মজে থাকা দর্শককে অনবরত দৃষ্টিসুখ প্রদান করতে হবে।
অন্যদিকে প্রসেনিয়ামও হয়ে ওঠে এক বিষম বাধা মৈমনসিংহ গীতিকা-র মত একটি পালাধর্মী নাটকের ক্ষেত্রে কেননা তা স্থাপত্যগত কারণেই বিভাজন তৈরি করে কলাকুশলীদের আর আগত দর্শকদের মধ্যে। মাথায় রাখতে হবে যে গ্রামাঞ্চলে এ ধরণের গান নির্ভর উপস্থাপনা এমন জায়গায় হত যেখানে কলাকুশলী আর দশর্ক থাকতেন একে ওপরের খুব কাছাকাছি। গীতিকা যদি হয় দুই ঘন্টার, গৌতম মেরে কেটে কুড়ি পঁচিশ মিনিট থাকেন মঞ্চে। বাকি সময়টা জুড়ে উনি দর্শকসারিতে, মাঝের হাঁটা চলার জায়গায় থেকে তার সমস্ত গান গেয়ে কথা বলে প্রাণান্ত চেষ্টা করেন ওই বিভাজন ঘোচাতে। তাতো হয়’ই না বরং তৈরী হয় আরো বড় সমস্যা। গৌতম হয়ে পড়েন বাকি কলাকুশলীদের থেকে বিচ্ছিন্ন এবং ঠিক এখান থেকেই সূচনা হয় দলবদ্ধ-যৌথ পারফরম্যান্সের বদলে একক পারফরম্যান্সের অভিঘাত।
শুধু যে স্থান গত ভিন্নতার কারণে (মঞ্চে বাকিরা, গৌতম নীচে) এই প্রযোজনাকে মাঝ বরাবর বিভক্ত মনে হয় তা নয়। কাজের মানের কারণেও এই উপস্থাপনা দুটো টুকরোয় ভাগ হয়ে যায়। মহুয়ার ভূমিকায় দ্যুতি এবং নদের চাঁদের ভূমিকায় পার্থিব রায় যথেষ্ট চেষ্টা করেছেন। তবে, গানের ক্ষেত্রে দ্যুতির উচ্চারণে শহুরে ছাপ তখনই কানে লেগেছে যখনই অভিনয়ের প্রয়োজনে দ্যুতিকে তার মনোযোগ গান থেকে কিছুটা সরিয়ে অন্যদিকে দিতে হয়েছে। পার্থিব কি গান একেবারেই গাইতে পারেন না? তাহলে তাকে গান কেন্দ্রিক এই নাটকে নেওয়া হোল কেন? শান্তনু ঘোষ সাধুর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে খুব অল্প সুযোগ পেয়ে গায়ক-অভিনেতা হিসেবে তিনি যে জাত শিল্পী তা বুঝিয়ে দিয়েছেন। তার গাওয়া সাধুর গানে আধুনিক নাগরিক গানের ছন্দ সুর যেমন চমকে দিয়েছে, তেমন তা এটার দিকেও দৃষ্টি আকষর্ণ করেছে যে সামগ্রিক ভাবে গানের ব্যাপারে এই প্রযোজনায় যতটা পরীক্ষামূলক হওয়ার সুযোগ ছিল তার সদ্ব্যবহার হয়নি। বহুবার দেখা গেছে যারা কোরিক রোল করছেন তারা নাচের সময় সঠিকভাবে যূথবদ্ধ থাকতে পারছেন না। চলাফেরায় সকলে মোটের ওপর একসাথে, একভাবে থাকছেন সেটাও হয়নি অনেক সময়। আগেই বলা হয়েছে গৌতমের পাশে বাকিদের উপস্থিতি বেশ ম্লান; এরজন্য যেমন তারা কিছুটা নিজেরা দায়ী, আরো বেশি দায়ী গৌতমের অনন্য দক্ষতা।
নিজের প্রতিভার জোরে এবং বহু বহু বছরের নিরলস সাধনায় নিজের দক্ষতা – তা গান গাওয়ার ক্ষেত্রেই হোক বা নাচের বা অভিনয়ের উৎকর্ষতা এমন স্তরে নিয়ে গেছেন গৌতম যে তার সাথে পাল্লা দিয়ে বা সঙ্গত করে কাজ করার মত অভিনেতা বিশেষ নেই বাংলা মঞ্চে। গীতিকা বলে শুধু গানের প্রসঙ্গেই যদি আসি, তাহলে এটা নির্দ্বিধায় বলা যায় মৈমনসিংহ গীতিকা-য় যে গান গৌতম গেয়েছেন তা বহু গায়কের ঈর্ষার কারণ হবে। সারা হল জুড়ে দাপিয়ে বেড়িয়ে, মঞ্চে উঠে নেমে অক্লান্ত ভাবে গানের পর গান নিখুঁত ভাবে গৌতম গেয়েছেন। প্রতিটা, হ্যাঁ প্রতিটা, গানের কথা-সুর-তাল-লয়-ছন্দ এবং ভাব গৌতম যেভাবে উপস্থাপনা করেছেন তা অবিস্মরণীয়। তিনি কথকের গান গেয়েছেন, তিনি নদের চাঁদের গান গেয়েছেন, তিনি হুমরা বেদের অভিনয় করেছেন (গলায় এক বিশেষ ধরণের কর্কশধ্বনি এনে) – তিনি ছেয়ে আছেন গোটা মৈমনসিংহ গীতিকা জুড়ে। তার অসামান্য দক্ষতা গৌতমকে যেমন দেয় পারফর্মার হিসেবে এক বিশাল উচ্চতা, আবার সেটাই তাঁকে একাধারে বসিয়ে দেয় একজন বিচ্ছিন্ন, নিঃসঙ্গ নটের আসনে। প্রশ্ন তোলে শিল্প মাধ্যম হিসেবে থিয়েটার কি ভাবে চর্চিত হবে তা নিয়ে। থিয়েটার (তা গ্রুপ থিয়েটারই হোক বা অন্য কিছু) কি একক শিল্পচর্চার আধার, যেমন ধরুন কবিতা যেভাবে একক চর্চার প্রকাশ? নয়ে নাটুয়া প্রযোজিত মৈমনসিংহ গীতিকা নাটকের শ্রোতা-দর্শক যতই ফিরে যান না কেন গৌতম হালদারের একক পারফরম্যান্সের জাদুতে আবিষ্ট হয়ে, থিয়েটার এখানে থেকে যায় মাধ্যমের নিজস্ব শিল্পবোধের সংশয়ে জর্জরিত হয়ে। গৌতমকে লম্বা কুর্নিশ করেও থিয়েটারের এই অপ্রয়োজনীয় অসহায়তায় আমরা ব্যথিত না হয়ে থাকতে পারলাম না।
দীপঙ্কর সেন