সিনেমার কথামানুষ মুহম্মদ খসরুকে মনে করে

Posted by Kaahon Desk On February 24, 2019

বাংলাদেশ সময় ও স্পেসের এক বাতিওয়ালা মুহম্মদ খসরু। আমৃত্যু তার সিনেমা। অপ্রাতিষ্ঠানিক মেজাজের রাগী বৈরাগী এই অকৃতদার মানুষটির ছিল সিনেমার সঙ্গে ঘরগেরস্হি— আমাদের সাংস্কৃতিক দস্তাবেজের হাতিয়ার।

মৃত্যু তাকে আক্রমন করেছে। তার জোব্বার পকেটে ছিল সিনেমার লেন্স।

“জীবনই মৃত্যু চলে গেছে,

মৃত্যুই জীবন আসছে।

তোমার কবরখানার সুশৃঙ্খল পরিবেষ্টনগুলো,

মৃত্যু রেখেছে বর্ণহীন, পরিত্যক্ত এবং সংখ্যাভিত্তিক।

জন্মের তারিখও পরিবারের নামগুলোকে তলিয়ে দিয়েছে ,

বিলুপ্ত করেছে শব্দকে;

আমরা শব্দ ও গোলাপের কথা ভাববো, তার অবয়ব দেখবো , জানতে পারবো আমরা কে ?দাঁড়িয়ে আছি কোথায় ? —মরণশীলতা—জন্মদাগ—–প্রতারণার মত।

শিল্পের যণ্ত্রপাতি হল লান্ছনা এবং দুঃখকষ্ট; আকাশের সীমানাতাই গৌরবের মাপ।

মৃত্যু হলো একটি রীতি। ঈশ্বর সব মানুষের এই একটি সমাধান দিয়েছেন।”

(হর্হে লুই বর্হেস/অনুবাদঃ মনোজ চাকলাদার)

খসরু ভাইয়ের সঙ্গে জরুরি আলাপ করতে হলে এখন আমরা সেলফোনে এগারো ডিজিটের khasruvie 01715 255 889  স্পর্শ করে রিং দিলে কেবল নারীকণ্ঠে একঘেয়ে উচ্চারণ ভেসে আসে, গ্রাহকের নাম্বারটি বন্ধ আছে, দয়া করে আবার চেষ্টা করুন। যোগাযোগ বৈকল্যের জন্য খসরুভাইয়ের সঙ্গে সংযোগ স্হাপন সম্ভবনা হলেও আমরা মনোজগতে তার সঙ্গে কথা বলতে থাকব।

Previous Kaahon Theatre Review:

আমরা মনে করতে পারব সালভেদর আলেন্দেকে পুনরুক্তি মুহম্মদ খসরু করেছিলেন, “নতুন সংস্কৃতি ও নতুন মানুষ সৃষ্টির জন্য মৌলিক হাতিয়ার হচ্ছে যোগাযোগ মাধ্যম (বেতার,সংবাদপত্র, প্রকাশনা, টেলিভিশন এবং চলচ্চিত্র)। সুতরাং এই মাধ্যমগুলোকে শিক্ষামূলক চেতনায় সম্পৃক্ত ও বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে মুক্ত হতে হবে।

গণসংস্কৃতির জাতীয় ধারাকে বিশেষভাবে চলচ্চিত্র শিল্প বিকাশের প্রতি সজাগ থাকতে হবে।গণযোগাযোগের মাধ্যমের জন্যে বিশেষ কর্মসূচি প্রণয়ন করার মধ্য দিয়ে তা সম্ভব হতে পারে।”

এই উদ্ধৃতি উৎকলনের মধ্য দিয়ে আমরা তার চেতনাগত যুদ্ধাবস্থা প্রত্যক্ষ করব। আমরা আরো উপলব্ধি করব, আশির দশকে বাংলাদেশে বিদ্যমান স্বৈরজমানায় উদ্ভুত লিটলম্যাগাজিন আন্দোলনের প্রতি তার উত্তাপময় সংস্পর্শগত অবস্হান ও সমর্থন।

তিনি শিক্ষকের ভূমিকা গ্রহণ করেননি কখনো। নিকট আত্মীয়তা ও প্রাণাবেগ জারী রেখেছিলেন। ঝড়ো বাতাসের মত দমকা দিয়ে কাঁপিয়ে দিতেন বেচাল দেখলে।

ব্যক্তিগতভাবে মনে পড়ে, নবারুন ভট্টাচার্যের হালাল ঝাণ্ডা, হারবার্টের মত গ্রণ্থের সাক্ষাৎ ও সংঘর্ষতার কল্যাণে একদা মুখোমুখি করিয়েছিল; জেনেছিলাম পেট্রোল দিয়ে আগুন নেভানোর কৌশল। এরকম আরো কত না অবলোকন দীর্ঘ করে চলে তালিকা।

তিনি বিশ্বাস করতেন; অনুপ্রেরণায় ধারণ করেছিলেন, নিজ পরিসরে, এই যে, চলচ্চিত্র সংসদ সাংস্কৃতিক আন্দোলনের দ্বিতীয় ফ্রন্ট।

সারা পৃথিবী জুড়ে সনাতন রীতি ভাঙার যে জোয়ার এসেছে, তার বড়শক্তি তরুন সম্প্রদায়।

১৯৬৩ সালে সুস্হ চলচ্চিত্রের পরিবেশ গড়ে তোলার জন্য প্রথম যে চলচ্চিত্র সংসদটি আয়ুবি স্বৈর-আমলে, মুক্তিযুদ্ধ-পূর্বকালে স্হাপিত হয়েছি তার মূলে খচিত ও রুদ্র ছিল তরুণকর্মীদের আন্তরিক নিষ্ঠা।

চলচ্চিত্রকে সামাজিক শক্তি হিশেবে ধারণ করা হয় কিনা — খসরু ভাইয়ের করোটিতেও বুকের বামপাশে এমন সব ধ্বনি ছিল। কর্মীদের নিয়ে লড়াই জারী রেখেছিলেন অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে।

স্বাধীনতার পর তার মনে হয়েছিল এদেশের সিনেমায় কিউবার মতো বিপ্লবাত্মক কর্মকাণ্ড সংগঠিত হবে। কিন্তু সরকারী উদাসীনতাও অবহেলার ফলে সিনেমা পরিণত হল চরিত্রহীন যেহেতু বেনিয়ারা কব্জা করে নেয় এই শক্তিশালী মাধ্যমটি।

লাতিন আমেরিকার চলচ্চিত্র ছিল উদ্বুদ্ধ করার মত। সেখানে চলচ্চিত্রকার ও বিপ্লবীর মধ্যে প্রভেদ নাই।

বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সংসদের আমন্ত্রণে পুণা ফিল্মইনস্টিটিউট থেকে আসেন চলচ্চিত্রজন সতীশ বাহাদুর ; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়-র এক সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানে তৎকালীন ভিসি আব্দুল মতিন চৌধুরী ঘোষণা করেছিলেন, অচিরেই বিশ্ববিদ্যালয়ে চলচ্চিত্র পাঠদানের ব্যবস্হা হবে।

একান্ত ভাবে চলচ্চিত্রভিত্তিক কাগজ ধ্রুপদী সংকলন হিসেবে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৬৮ সালে। বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সংসদের মুখপত্র হিসেবে ধ্রুপদী চলচ্চিত্রের নন্দন তত্ত্বতাত্ত্বিক তায় বিশ্বাসী ও বাণিজ্যিকতার বিরোধী ছিল। সম্পাদক ছিলেন মুহম্মদ খসরু। এছাড়াও একটি বুলেটিন প্রকাশিত হতো ‘চলচ্চিত্রপত্র’ নামে। ‘ক্যামেরা যখন রাইফেল’ ছিল তার আরেকটি কাজ।

ধ্রুপদী ছিল নির্মল চলচ্চিত্রের আন্দোলনের মুখপত্র। চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এধরণের আন্দোলন বড় একটা নতুন নয়। চলচ্চিত্র কলার প্রারম্ভ থেকে আঙ্গিক এবং বিষয়বস্তুর ও পর সংঘটিত হয়েছে একের পর এক আন্দোলন যেমন,  এক্সপ্রশনিস্ট, ইম্প্রেশনিস্ট,  দাদাইস্ট স্যুররিয়ালিস্ট প্রভৃতি ইয়োরোপীয় আন্দোলন ছাড়াও সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক বাস্তববাদ, ফরাসি আভাগার্ড, ইটালীয়ন ব্যবাস্তববাদ, ফরাসি নবতরঙ্গ, মার্কিনি নিউসিনেমা ও আন্ডারগ্রাউন্ড। আমাদের দেশেও এমন একটি সর্বাত্মক আন্দোলনের প্রয়োজন অনুভব করেছিল সংসদ, খসরুভাই ও অপরাপরগণ।

Film activist Mohammed Khasru

পাকিস্তানী বিরূপ সাংস্কৃতিক পরিস্হিতিতে চিত্রনাট্য তৈরির কলাকৌশলের পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ চিত্রনাট্যের নমুনা হিসেবে ঋত্বিক ঘটকের নাগরিক, মৃণাল সেনের পুণশ্চমুদ্রিত হয়েছিল। পাকিস্তানি বৈরী জমানায় নিঃসন্দেহে এই সমূহ প্রকাশেও সাহসী অক্ষরমালায় সাজানো ছিল ধ্রুপদী।

চলচ্চিত্র বিষয়ক লেখাজোখা , চলচ্চিত্র সাংবাদিকতা , সব মিলিয়ে চলচ্চিত্র সাহিত্য বিনির্মাণ করে ধ্রুপদী। গড়ে তোলে নিজস্ব লেখক গোষ্ঠী যারা রচনা করেন চলচ্চিত্র ভিত্তিক প্রবন্ধ , কারিগরী আলোচনা, সাক্ষাৎকার, অনুবাদ। চলচ্চিত্র কর্মীরা ছিলেন লেখক-প্রকাশক। সম্পাদক ছিলেন অগ্রগণ্য চলচ্চিত্র কর্মী মুহম্মদ খসরু। তিনি গুরু বাওস্তাদ বলে সম্বোধিত হতে অনিচ্ছুক ছিলেন বরং সকলের খসরুভাই –এভাবেই তাকে মানাতো বড়।

বিশিষ্ট চলচ্চিত্র নির্মাতা রাজেন তরফদারের পালঙ্ক -তে সহকারী পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন।

সাক্ষাৎকার চতুষ্টয় ও বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলন তার উল্লেখযোগ্য গ্রণ্থ।

১৯৭৮সালে বাংলাদেশ ফিল্মআর্কাইভ গঠনের প্রধান কারিগর তিনি।

সিনেমা তৈরি করতে চেয়েছিলেন। স্ক্রীপ্ট প্রস্তুত। কোনও প্রযোজক এগিয়ে আসেনি। সরকারী অনুদানও অন্যপাত্রে বরাদ্দ হয়েছে।

খসরুভাইয়ের মুখের ভাষা নিয়ে বলবার প্রয়োজন। সশব্দে তার অবস্হান; মান্য কথ্যের নীচে, কিন্তু অশ্লীলতার ওপরে। তিনি ছিলেন অকপট ও সরাসরি। রেখে-ঢেকে কথা বলতে পারতেন না।

শব্দ দিয়ে ধাক্কা মারার কথা বলা যায়। শব্দ সর্বময় হাতিয়ার। ভাষা মানুষ গড়ে তোলে নিজের প্রযোজনে। হতে পারে চলচ্চিত্রের ভাষা, সাহিত্যের ভাষা, মুখের ভাষা। তেজ, প্রাখর্য ও শিহরণ নিয়ে গড়ে এই ভাষা। ভাষার দস্যিপনার মধ্যে গতি আছে। সব ভাষায় অনাচারি কদস্যিপনার লক্ষণ থাকে। ভাষার ভদ্রায়ন এমনই এক প্রক্রিয়া তাতে ভাষা বন্দী হয়। ভাষাকে যারা এমন লীলাসঙ্গী ভাবেন, ভদ্রলোকদের বিচারে তারা অশিষ্ট, অমার্জিত ও প্রান্তিক।

খসরুভাই ডারউইনিজমে বিশ্বাসী ছিলেন। ভেতরে বাস করত শিশু। ব্যক্তিজীবনে নিঃসঙ্গ, একাকী ও সুদূর ছিল।

তার প্রিয় গানছিল “ধনধান্য পুষ্পভরা…..এদেশেতে জন্ম আমার,  এই দেশে তে মরি….”, অতএব এই সমগীতের মধ্য দিয়ে তিনি চলে গেলেন। শেষ বাসে চড়ে গন্তব্য তখন লাস্ট স্টপেজ। বিরতিহীন উৎসব থেকে আমাদের নায়কের বিদায়।

খসরুভাইয়ের সঙ্গে আমাদের কথা চলতে থাকবে।

Syed Reazur Rashid
Writer and essayist, lives in Bangladesh. A close observer of society & politics, economics & culture against globalization.

Related Updates

Comments

Follow Us

Show Calendar

Message Us