সৈকত চক্রবর্তী
“I can take any empty space and call it a bare stage. A man walks across this empty space whilst someone else is watching him, and this is all that is needed for an act of theatre to be engaged.” [1]
নাটকের চরম মুহূর্ত উপস্থিত। বিভিন্ন স্বতন্ত্র প্রমাণ থেকে নায়কের কাছে এখন পরিষ্কার যে সে নিজের বাবাকে হত্যা করে নিজের মায়ের সাথে করেছে বিয়ে। যে গর্ভে তার নিজের উৎপত্তি সেখান থেকেই তার নিজের সন্তানদেরও জন্ম। যা দেখা শুধু অন্যায় নয় , শুধু পাপ নয়, অচিন্তনীয় – তাই সে দেখেছে। এহেন মর্মান্তিক সত্যের মুখোমুখি হয়ে সে কার কাছে যাবে? তার মায়ের কাছে? তার স্ত্রীয়ের কাছে? কিন্তু তারা যে এক এবং অদ্বিতীয়। সেটে দেখা যাচ্ছে দু দিক দিয়ে দুটো সিঁড়ি ওপরের দিকে উঠে গেছে। এই বিপুল টেনশন, এই নিদারুণ যন্ত্রণা, ব্যক্ত করার জন্য আমাদের নায়ক একবার এই সিঁড়ি একবার অন্যটি দিয়ে, একবার নিজের মাকে একবার নিজের স্ত্রীকে ডাকতে ডাকতে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে উঠছেন, দর্শক করতালিতে ফেটে পড়ছে।
বাংলা নাটকের সাথে আমার পরিচয় নেহাতই একজন দর্শক হিসেবে। এবং সেই পরিচয়টাও খুব বেশিদিনের নয়ও। বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশুনো শেষ করে বহুদিন উচ্চতর শিক্ষার জন্য কলকাতার বাইরে কাটাতে হয়। কলকাতায় থাকাকালীন, যে কারণেই হোক, নাটক দেখা হয়ে ওঠেনি। কিন্তু বিদগ্ধ লোকেদের কাছে কলকাতার গ্রুপ থিয়েটারের গুণগান শুনতাম; শম্ভু মিত্র, উৎপল দত্তের কথা শুনতাম। দেখতাম লোকে ফিল্মে ভালো অভিনয় দেখলে তাকে ‘থিয়েটার স্ট্যান্ডার্ডের অভিনয়’ বলে। তাই কলকাতার গ্রুপ থিয়েটারের নাটক এক্সপ্লোর করার ইচ্ছেটা বরাবরই ছিল।
এই প্রবন্ধের সূচনার নাটকটা বাংলায় এতবার এত লোকে মঞ্চস্থ করেছে যে নাট্যপ্রেমী বাঙালি মাত্রেই এর সঙ্গে পরিচিত। এবং আমার প্রাপ্তবয়সে বাংলা নাটক দেখা এই নাটক দিয়েই শুরু, আজ থেকে বছর ছয়েক আগে। দৃশ্যপটের ‘অয়দিপউস’, নামভূমিকায় দেবশঙ্কর হালদার। নাটকের প্রোগ্রামে, যাকে কলকাতায় ‘ফোল্ডার’ বলে, স্পষ্টই বলা আছে যে ভাষান্তরিত করার সময় অনুবাদক হর ভট্টাচার্য সোফোক্লিস্ বা সেনেকার টেক্সটের কোন ধার ধারেন নি। বলাই বাহুল্য যে নাটকটি দেখলে এ বিষয়ে আর সন্দেহ থাকেনা। চড়া অভিনয়, উগ্র কস্টিউম, কল্পনাশক্তিহীন শব্দ, হাস্যকর গান মিলিয়ে সে এক কাণ্ড! এর সাথে মানবসভ্যতার প্রাচীনতম ট্র্যাজেডি কি আর পেরে ওঠে? দর্শকের আসনে বসে মঞ্চে অভিনেতাদের স্থূল আস্ফালন দেখে আমাদেরই এমব্যারাসড লাগে। অভিনেতারা যে তা কী ভাবে অবলীলায় পেরে ওঠেন ভেবে বিস্ময় হয়।
[1] Brook, P. (1996). The empty space: A book about the theatre: Deadly, holy, rough, immediate. Simon and Schuster.
এই নাটকটি দেখে মনে হয়েছিল এ হয়তো বিচ্ছিন্ন একটা উদাহরণ। স্বাভাবিকভাবেই এই একটি মাত্র অভিজ্ঞতা দিয়ে সমগ্র গ্রুপ থিয়েটার সম্বন্ধে কোনরকম মতামত দেওয়া চলেনা, আর নাটক না দেখার তো কোনও প্রশ্নই ওঠেনা। তাই এর পরও প্রচুর বাংলা নাটক দেখেছি। কিন্তু বারে বারে এই একই ঘটনারই পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। ক্বচিৎ যখন এর ব্যতিক্রম ঘটেছে, তখন সত্যিই বড় অবাক হয়েছি। বারংবার এই অভিজ্ঞতায় নাটক দেখাটা ম্যাসোকিস্মের পর্যায়ে চলে যাচ্ছে দেখে অধুনা বাংলা নাটক দেখা একেবারেই ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছি।
নাম করা কিছু দলের নাটক দেখার অভিজ্ঞতার কিছু উদাহরণ দিই। বহুদিন ধরে শুনেছিলাম নান্দীকারের নাম। তাদের কর্ণধার রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত নিঃসন্দেহে কলকাতার নাট্যজগতের প্রথম সারির নাট্যব্যক্তিত্বদের একজন। তাই সাহস করে দেখতে গেলাম ‘নাচনী’ নাটকটি। নাটকটির বিষয়বস্তুর গুরুত্ব অনস্বীকার্য। নাটকটি বিশেষ এক ধরনের মানুষ, বিশেষত মহিলাদের কথা আমাদের বলছে, যাদের সম্বন্ধে আমি অন্তত অবগত ছিলাম না। যেহেতু এই মহিলারা গান গেয়ে এবং নাচ দেখিয়ে জীবিকা অর্জন করেন তাই স্বাভাবিকভাবেই নাটকটিকে মিউজিক্যাল হিসেবে পরিবেশন করা হয়েছে। কিন্তু মিউজিক্যাল করার জন্য যে গায়কী এবং ফিটনেসের প্রয়োজন তা কুশীলবদের নেই এবং তা অর্জন করার চেষ্টাও কোথাও চোখে পড়েনা। গায়িকা এবং যন্ত্রশিল্পীদের সঙ্গত মেল খায়না এবং যথারীতি তা অত্যন্ত কানে বাজে। সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার সেই অসামঞ্জস্য শোধরানোর কোনরকম চেষ্টাও করেন না। এছাড়া দেবশঙ্কর, সোহিনী, স্বাতীলেখা এবং রুদ্রপ্রসাদের অতিঅভিনয় তো আছেই। অপর্যাপ্ত রিহিয়ের্সাল, টেকনিকাল দুর্বলতা এবং সে সম্বন্ধে কর্মীদের চরম উদাসীনতা সব ক’টা ইন্দ্রিয়কেই অত্যন্ত বিব্রত করে। কিন্তু যখন দেখা যায় দর্শক এটাকেই সাধুবাদ জানাচ্ছে, তারিফ করছে, প্রেক্ষাগৃহ করতালিতে ফেটে পড়ছে, তখন উৎকর্ষের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে মনে প্রশ্ন না এসে পারেনা। আমাদের থ্রেশ্হোল্ড যদি এতটাই কম হয়, তাহলে কেউ নিজের ক্ষমতার লিমিট পরীক্ষা করবেও বা কেন, নিজেকে ছাপিয়ে যাওয়া তো দুর-স্থান। এও যদি যথেষ্ট না হয়, নাটকের শেষে দেখা গেল রুদ্রপ্রসাদবাবু স্টেজ থেকে পা ঝুলিয়ে বসে আছেন এবং অডিটোরিয়াম থেকে বেরোনোর পথে একে একে বেশ কিছু দর্শক লাইন থেকে বেরিয়ে গিয়ে ওনার পায়ের ধুলো নিচ্ছেন। সব মিলিয়ে প্যাকেজটা সাধুভাষায় যাকে বলে শ্যারাড ঠিক তাই।
নান্দীকরের ‘আন্তিগোনে’ এক সময়কার সারা জাগানো নাটক বলে শোনা যায়। যদিও ইউটিউবে এর রেডিও সংস্করণটি শুনলে সারা ফেলার কারণটি স্পষ্ট হয় না, কারণ তার মধ্যেও সংলাপের কৃত্রিমতা, মাত্রাতিরিক্ত আবেগ এবং অভিনয়ে শৈথিল্য একইরকমভাবে উপস্থিত।[2] যাকগে, স্বপ্নসন্ধানীর ‘আন্তিগোনে’ নাটকটি দেখার সুযোগ হয় কোন এক বছরের নান্দীকার থিয়েটার ফেস্টিভালে। নাটকটি দেখলে বোঝা যায় যে পরিচালক মূল নাটকটির কোন প্রামাণ্য অনুবাদ পড়ে দেখবার প্রয়োজনও বোধ করেননি এবং প্রোডাকশনটিকে পুরোপুরি নান্দীকারের টেক্সটের ওপর ভিত্তি করেছেন। কারণ, নান্দীকার এবং স্বপ্নসন্ধানীর ‘আন্তিগোনে’ ঠিক একই জায়গাগুলোতেই সোফোক্লিস্ থেকে আলাদা। ক্রিয়নের ভূমিকায় পরিচালক কৌশিক সেনের অভিনয় চলনসই হলেও নাম ভূমিকায় রেশমি সেনের অভিনয় অতিনাটকীয়। কুশীলবদের অনর্গল একঘেয়ে অভিনয়ে নাটকের উপজীব্য খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।
[2] https://www.youtube.com/watch?v=Yqh0IviSXE8 ;
https://www.youtube.com/watch?v=3ms3PNylZuw
আর মাত্র একটি উদাহরণ দিয়ে বাংলা নাটকের ক্রেম্ দে লা ক্রেমের বর্তমান মান যে কোথায় রয়েছে সেই বিবরণ শেষ করব। গত কয়েক বছরের কলকাতার নাট্যজগতে সাঙ্ঘাতিক সাড়া ফেলে দেওয়া একটি নাটক অর্ণ মুখোপাধ্যায় পরিচালিত ‘অথৈ’। প্রযোজকদের দাবী এই নাটক উইলিয়ম শেক্সপিয়রের ‘ওথেলো’ অবলম্বনে। এতে অনির্বাণ ভট্টাচার্যের ইয়াগোর ভূমিকায় অভিনয় নিয়ে যথেষ্ট কি-স্ট্রোক্ খরচ হয়েছে। কিন্তু এই নাটকটি দেখার মত অস্বস্তিকর অভিজ্ঞতা আমার জীবনে খুব বেশী হয়নি। বস্তুত: এই নাটকটিকে ড্রামা স্কুলে পারফর্মিং আর্টসে মাত্রার গুরুত্ব বোঝানোর জন্য, অবশ্যই ঋণাত্মক অর্থে, দেখানো যেতে পারে। কোনও আইডিয়া ক্রমাগত কচলাতে থাকলে সেটা তেতো হতে বাধ্য, এবং এই নাটক তার জলজ্যান্ত প্রমাণ। নাটকটির যথাযথ মূল্যায়ন এই প্রবন্ধের পরিসরে কুলনো মুশকিল। তা সত্ত্বেও কয়েকটি উদাহরণ এখানে না দিয়ে পারছিনা। পরিচালকের টেক্সচুয়াল ইন্টারপ্রিটেশান নিয়ে এখানে যাচ্ছি না, কারণ সেখানে প্রবল গোলমাল, এরকম মোটা দাগের এবং ভুল এবং স্থূল ইন্টারপ্রিটেশান আপনার আমার দ্বারা সম্ভবপর হতনা। এখানে উদাহরণগুলো তাই শুধুমাত্র অভিনয়েই সীমাবদ্ধ রাখব।
নাটকে যখন যখন ইয়াগোর মনে ইভিল যাগে (বিশ্বাস করুন, এক বিন্দুও বানিয়ে বলছিনা), পাছে দর্শক সেটা ধরতে না পারে (আমরা তো নির্বোধ) তাই বিশেষ ধরনের ইভিল বাজনা এবং আলোর ব্যাবহার করা হয়। যেন এও যথেষ্ট নয়, ইয়াগো মঞ্চে হাত পা বেঁকিয়ে, কুঁজো হয়ে ডিফর্মড্ সেজে ঘুরে বেড়ায়। যেন এও যথেষ্ট নয়, এক দল কালো পোশাক পড়া মানুষকে মঞ্চে দেখা যায়, যারা ইয়াগোর সাথে সাথে ডিফর্মড্ সেজে ঘুরে বেড়ায়! এবং প্রত্যেকবারই সমূহ দর্শক বিপুল হর্ষধ্বনিতে ফেটে পড়ে। ২০১৯এ দাঁড়িয়ে ডিফর্মিটির সাথে ইভিলের এই ব্যানাল তুলনা যে কেউ টানতে পারে, আর তাতে যে দর্শক আর সমালোচক কারোরই কিছু মনে হয়না, এতে অবাক না হয়ে পারিনা। নাটকে ইয়াগোর সাথে ক্রিস্টোফার নোলানের ‘দ্য ডার্ক নাইট’ ছবির জোকারের তুলনা আনা হয়েছে। একটি দৃশ্যের পর থেকে মঞ্চে তাই আমরা জোকারের মাস্ক দেখতে পাই। তার পরের কয়েকটি দৃশ্যে দেখি ইয়াগো নিজে জোকারের মাস্ক পরে আছে। তারপর এক সময় সে মাস্ক খুলে ফেলে এবং দর্শকদের প্রশ্ন করে “আপনাদের জোকারের চরিত্রটা কেমন লাগে?”। এ যেন চোখে আঙুল দিয়ে এফোঁড় ওফোঁড় করে দেওয়ার সামিল।
এ হল যাকে ম্লেচ্ছ ভাষায় বলে ‘টিপ্ অফ দ্য আইসবার্গ’। এরকম অজস্র অহেতুক থিয়াট্রিক্সে নাটকটি জর্জরিত। তার আর ফিরিস্তি এখানে দিচ্ছিনা। শুধুমাত্র আর একটি কথা এখানে না বললেই নয়। নাটকের শেষে কার্টেন কলের সময় দেখা যায় যে সমস্ত কুশীলব স্টেজে বসে আছে এবং সবার চোখে জল – সম্ভবত এই পারফর্মেন্সের ইন্টেন্সিটি ওদের ওপর যে টোল নিয়েছে সেটা বোঝাতে। এই ধরনের সস্তার চটককে ভণ্ডামি ছাড়া আর কিছু মনে হওয়া শক্ত।
তার মানে বাংলায় ভালো নাটক কি হচ্ছেনা? ভালো নাটকের বিরল কিছু নিদর্শন যে নেই, তা বলা চলে না। যেমন সুমন মুখোপাধ্যায়ের ‘যারা আগুন লাগায়’, ম্যাক্স ফ্রিশের ‘দ্য আর্সনিস্ট’ অবলম্বনে। কলকাতায় বসে যে কোনদিন এরকম একটা বাংলা নাটক দেখতে পারব, সত্যিই একসময় সে আশা ত্যাগ করেছিলাম। অভিনয়, প্রেসেন্টেশন্, আলো, সেট, সব বিষয়েই নাটকটি ব্যতিক্রমী। অভিনেতাদের অভিনয়শৈলী, স্পেস ব্যবহারের ক্ষমতা এবং ফিটনেস অভিভূত করে। নবারুণ ভট্টাচার্যের অনবদ্য অনুবাদের কথা তো ছেড়েই দিলাম।
এই তো গেল বাংলা নাটকের বর্তমান অবস্থার কিছু নিদর্শন। কিন্তু এহেন দুরবস্থার দায়িত্ব কার? শুধুমাত্র কি নাট্যকর্মীদের? বলতে বাধা নেই, এ দায় কিন্তু আমাদের সবার, আমরা যারা থিয়েটারকে একটা আর্ট ফর্ম একটা শৈল্পিক মিডিয়াম হিসেবে ভালবাসি, তাদের। নাট্যকর্মীদের সাঙ্ঘাতিক কন্স্ট্রেইন্টের মধ্যে কাজ করতে হয়। সীমিত বাজেট, সীমিত সময় – অনেকেই নামমাত্র পারিশ্রমিকে কাজ করেন। একটা নাটক মঞ্চস্থ করতে যে কি পরিমাণ অমানুষিক পরিশ্রম করতে হয়, তা আমার মত ঠাণ্ডা ঘরে বসা ল্যাপটপের সামনে বিষোদ্গারে যারা ব্যস্ত তাদের পক্ষে অনুধাবন অসম্ভব। এবং স্টেজকে ভাল না বাসলে, থিয়েটারে অপরিসীম অনুরাগ না থাকলে এই পরিশ্রম করা সম্ভবও নয়। তবু নাট্যকর্মীদের উদ্দেশ্যে দুটো একটা কথা না বললেই নয়। এবং এই কথাগুলো বলা, ভালো বাংলা নাটক দেখবার তীব্র আকাঙ্ক্ষা নিয়েই।
১) নাটকের বিষয়বস্তুর বৈচিত্র্য আনলে ভালো হয়। কলকাতার মঞ্চে একই নাটক বার বার হয়ে থাকে – বিশেষত একই গ্রীক নাটক ঘুরেফিরে বিভিন্ন গ্রুপের রিপেরটোয়ায় স্থান পাচ্ছে দেখি। পৃথিবীর আরও অনেক দেশে অনেক ভালো ভালো নাটক লেখা হয়েছে এবং হচ্ছে। সেগুলো করার চেষ্টা করা যেতে পারে। একটা বিরাট সমস্যা হচ্ছে এই মুহূর্তে বাংলা ভাষায় এক জনও ভালো নাট্যকার নেই। আশা করা যায় যে ভবিষ্যতে কেউ হয়ত বাংলায় আবার ভালো নাটক লিখবেন।
২) এ ধারনা ভুল যে পর্দায় রিয়ালিস্টিক অভিনয় চলতে পারে কিন্তু মঞ্চে সেটা চলেনা। বিশ্বাস করুন স্টেজে অতিঅভিনয় দর্শকের কাছে একই রকম পীড়াদায়ক। নাসিরুদ্দিন শাহ্কে দেখুন, পর্দাই বলুন আর স্টেজ, দু জায়গাতেই কেমন পরিমিত অভিনয় করেন। পৃথিবী জুড়ে এরকম অনেক অভিনেতার উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে যেমন, জুডী ডেঞ্চ, প্যাট্রিক স্টিউয়ার্ট, ইয়ান ম্যাকেলেন, হেলেন মিরেন, অ্যাল পাচিনো, লার্স আইডিঙ্গার, জুড ল প্রভৃতি, যারা দুটি মাধ্যমেই একই রকম শক্তিশালী।
৩) শম্ভুবাবুর ‘রাজা অয়দিপাউস’এর দূরভাষ সংস্করণ শুনলে বোঝা যায় যে গত পঞ্চাশ বছরে কলকাতার গ্রুপ থিয়েটারে অভিনয়ের ধরণ বিন্দুমাত্র পালটায়নি। শম্ভু মিত্র, উৎপল দত্তর ছায়া থেকে না বেরোনো পর্যন্ত বাংলা নাটকের স্থবিরতা ঘোচার তেমন আশা দেখিনা। কথায় বলে “Atrue student is the one who ends up betraying the master”। যদি তা না হত, তাহলে স্তানিস্লাভস্কির পরে মেয়েরহল্ড, এবং মেয়েরহল্ডের পরে গ্রোটস্কি আসতেন না! [3]
৪) নাটক দিয়ে সমাজ পরিবর্তন সম্ভব নয়। তাই নাটককে সোশ্যাল ডকুমেন্ট বা সামাজিকভাবে প্রাসঙ্গিক করার চেষ্টা বেকার। থিয়েটারের তাগিদে থিয়েটার করলেই বোধ হয় ভাল।
৫) যে কোন পারফর্মিং আর্টের জন্যই ফিটনেস অত্যাবশ্যক। এবং তার অভাব মঞ্চে অত্যন্ত চোখে লাগে। তাই এ বিষয়ে মনোযোগ দেওয়া মনে হয় দরকার।
৬) গান গাইতে না পারলে এবং ফিটনেস না থাকলে মিউজিক্যাল করার চেষ্টা বোধহয় না করলেই ভাল। হবিব্ তন্ভীরের ‘চরনদাস চোর’ বা ‘কামদেও কা অপ্না বসন্ত্ ঋতু কা সপ্না’য়[4] দেখুন কি অনবদ্য গান এবং নাচ।
৭) বেশীরভাগ নাটকই দেখতে গেলে মনে হয় যে খুব তাড়াহুড়ো করে মঞ্চস্থ করা। টেক্সটের ইন্টারপ্রিটেশন এবং রিহিয়ের্সালে আরও সময় এবং মনোযোগ দেওয়া দরকার।
৮) দর্শক বুদ্ধিমান হতেও পারে। সুতরাং সব কিছু চোখে আঙ্গুল দিয়ে না দেখিয়ে দিলেও চলতে পারে। এতে কিন্তু দর্শকদের প্রতি যারপরনাই অশ্রদ্ধা প্রকাশ পায়।
৯) নাটকের পোস্টারে ‘ব্রেখট অবলম্বনে’, ‘কাফকা ভাবনায়’, ‘মোলিয়ের অনুপ্রাণিত’ অত্যন্ত প্রিটেনশিয়াস। লেখকের মূল লেখাটার নাম পরিষ্কার করে বলতে বাধাটা কোথায়? দর্শক গল্পটা জেনে আসবে তার ভয়?
১০) দেখা গেছে নাটকের দলে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র না থাকলে, সেই দলে অনিবার্যভাবেই স্থবিরতা আসে। এমনকি বেয়ের্তোল্ত ব্রেশ্তের বেয়ের্লিনের অন্সাম্বল্ও এর ব্যতিক্রম নয়।[5] অন্যদিকে অনেক পরিচালকই নিজেদের সেরা প্রোডাকশনগুলোর সাফল্যের জন্য দলগত প্রচেষ্টাকেই কৃতিত্ব দেন।[6] এ ব্যাপারে বাংলা নটুয়ারা ভেবে দেখতে পারেন।
১১) নাটক করার সাথে সাথে নাটক নিয়ে পড়াশুনো করাও প্রয়োজন। ফিল্মের মতই নাটক নিয়েও প্রচুর লেখালেখি হয়েছে এবং হচ্ছে। সেগুলোর সাথে ওয়াকিবহাল হলে নাট্যকর্মীরা উপকৃত হতে পারেন।
১২) ভালো ফিল্ম না দেখলে যেমন ভালো সিনেমা বানানো যায়না, সেরকমই ভালো থিয়েটার দেখার অভিজ্ঞতা না থাকলে ভালো নাটক করা যায়না। তাই কলকাতায় যখন মট্লি-মুম্বইয়ের ‘আ ওয়াক টু রিমেম্বার’ বা শাওব্যুহ্নে বেয়েরলিনের ‘এনেমি অফ থে পিপ্ল’ মঞ্চস্থ হয়, তখন সেই সুযোগগুলো নেওয়া দরকার। এছাড়া অনলাইনও আজকাল প্রচুর ভালো নাটক দেখা সম্ভব। তবে এ প্রসঙ্গে একটা কথা বলা প্রয়োজন। যে কোন আর্ট ফর্মের শ্রেষ্ঠ নিদর্শনের সঙ্গে পরিচয় সেই আর্টের প্র্যাক্টিশনারদের জন্য necessary, কিন্তু তা বলে সেটা কিন্তু sufficient নয়। এর জ্বলন্ত প্রমাণ, বর্তমান বাংলা সিনেমা।
এবার আসি সমালোচক, সংবাদপত্র এবং অন্যান্য পত্রপত্রিকার কথায়। থিয়েটার সমালোচনার মান, অন্তত মেইনস্ট্রিম প্রেসে (যথা আনন্দবাজার পত্রিকা, দ্য টেলিগ্রাফ, প্রভৃতি), রুডিমেন্টারি বললেও অত্যুক্তি হয়। বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই এই সমালোচনাগুলো পড়লে মনে হয় যে এর দায়িত্ব রুকি জার্নালিস্টদের ওপর ন্যস্ত। তাই যে নাটকই হোক যেমন নাটকই হোক দেখা যায় সমালোচনায় ভূয়সী প্রশংসা ব্যতীত আর কিছুই নেই। যখন এই পত্র-পত্রিকাগুলোতে কোন নাট্যব্যক্তিত্যের সাক্ষাৎকার ছাপা হয় দেখি সেখানেও শুধু মহিমাকীর্তন ছাড়া আর কিছুই স্থান পায় না, সাংবাদিক সেখানে একটিও অস্বস্তিকর প্রশ্ন করেননা, থেস্পিয়ানের দক্ষতা, তার দুর্বলতা নিয়ে কোন প্রশ্ন করেন না। অথচ থিয়েটারের উন্নতির পেছনে সমালোচকদের অবদান অনস্বীকার্য। গত শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে যখন ইংলিশ থিয়েটার প্রায় স্তব্ধ হতে বসে, তখন কেনেথ্ টাইনান তার ক্ষুরধার লেখনী দিয়ে সেই আবর্জনা পরিষ্কারের দায়িত্ব হাতে নেন। বলা হয়ে থাকে যে বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে ইংলিশ থিয়েটারে যে বিপ্লব আসে, তা খানিকটা হলেও টাইনানের নিরলস প্রচেষ্টায়।[7] তাই বাংলা থিয়েটারেও সেরকম কলমকাটা সমালোচক চাই, যারা একটা বাজে প্রোডাকশনকে খারাপ বলতে পারবেন, এবং অবশ্যই যদি কোন নাটক ভালো হয়, তার সঠিক গুণবিচার করবেন। কিন্তু যতদিন তা না হচ্ছে, যতদিন মুড়ি এবং মুড়কি একই রকম সাধুবাদ পাচ্ছে, ততদিন বাংলা থিয়েটারের উন্নতির আশা দেখিনা।
সবশেষে আমাদের কথায় আসি, আমরা অর্থাৎ দর্শকেরা, কারণ আমাদের জন্যেই তো এত আয়োজন। আগেই বলেছি, আমাদের থ্রেশ্হোল্ড বড্ড কম। অবশ্যই নাটক দেখুন এবং অন্যদেরকেও নাটকে ইনিশিয়েট করান। আমাদের পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া তো থিয়েটারই থাকবেনা। সেটা তো আর আমরা চাই না। কিন্তু আমরা যদি সব নাটক দেখেই তার তারিফ করি, স্ট্যান্ডিং ওভেশন দিই, তামাশা দেখে তালি বাজাই – তাহলেও বা চলবে কেমন করে? আমাদেরও ক্রিটিকালি সব নাটক দেখতে হবে এবং তা নিয়ে অন্যদের সাথে কথা বলতে হবে। কোনটা আমরা গ্রহণ করছি আর কোনটা করছি না, তা তো কুশীলবদের টের পাওয়াতে হবে। তবেই তো তারা নিজেদের আরও ভাল করার সুযোগ পাবেন।
প্রেক্ষাগৃহে সবার সাথে বসে সামনা সামনি নাটক দেখার মজাই আলাদা। কিন্তু বিশ্বের অন্যান্য দেশের নাটক সামনে থেকে প্রত্যক্ষ করার সৌভাগ্য আমাদের মধ্যে ক’জনেরই বা হয়। ইদানীং ইন্টারনেটের মহিমায় বিভিন্ন দেশের নাটক আমরা ঘরে বসেই উপভোগ করতে পারি। ব্রিটেনের Royal Shakespeare Company এবং Royal National Theatre তাদের বিভিন্ন নাটক নিয়মিত সিনেমা হলে Live দেখায় (যথাক্রমে RSCLIve[8] এবং NTLive[9])। কলকাতায় তা দেখানো হয়না কারণ এর চাহিদা নেই বলে, যদি আমরা যথেষ্ট উৎসাহ দেখাই তাহলে মুম্বই বা দিল্লির মত কলকাতাতেও এগুলো দেখানো হতে পারে। এছাড়া Cheek By Jowl[10] এবং Complicité[11] তাদের নতুন প্রোডাকশনগুলো প্রায়শই Live Stream করে থাকে, এবং যা আমরা যে কোন ডিভাইসেই দেখতে পারি। এছাড়া YouTubeএর দৌলতে আমরা দেখে নিতে পারি Schaubühne Berlinএর Richard III বা Hamletএর মত নাটকগুলি (পরিচালক- টোমাস্ ওস্টারমায়ার, যাকে এক সময় ইউরোপিয়ান থিয়েটারের enfant terrible বলে অভিহিত করা হত)।[12] Digital Theatre [13]এ দেখে নিতে পারি বিভিন্ন ভাষার সেরা নাটকগুলি। অন্যান্য ভাষার ফিল্ম দেখে যেমন আমরা বুঝতে পারি যে সিনেমা মিডিয়ামটা নিয়ে সারা বিশ্বে কি চলছে, সেরকমই অন্যান্য দেশের নাটক দেখার এই সুযোগে আমরা বুঝতে পারি যে থিয়েটার নিয়েও কত কিছু করা সম্ভব। একমাত্র ভালো নাটক দেখলেই হয়ত খারাপের সাথে তার তারতম্য বোঝা সম্ভব। আর দর্শক সমঝদার না হলে বাংলা নাটকও এরকম স্তব্ধই রয়ে যাবে।
[3] McCaw, D. (2015). Bakhtin and Theatre: Dialogues with Stanislavski, Meyerhold and Grotowski. Routledge.
[5] Hall, P., & Goodwin, J. (2016). Peter Hall’s diaries: the story of a dramatic battle. Oberon Books.
[6] Hall, P. (2000). Making an Exhibition of Myself: the autobiography of Peter Hall: The Autobiography of Peter Hall. Oberon Books.; Brook, P. (2018). The Shifting Point: Forty Years of Theatrical Exploration, 1946–87. Bloomsbury Publishing.; https://www.youtube.com/watch?v=vaUHxKXjkwI
[7] https://www.theguardian.com/theobserver/2016/dec/04/kenneth-tynan-intellectual-slum-clearance-stage-susannah-clapp; Tynan, K., Shellard, D., & Stoppard, P. (2007). Kenneth Tynan: Theatre Writings. Nick Hern Books.
[8] https://homemcr.org/rsc-live/
[9] http://ntlive.nationaltheatre.org.uk/
[10] https://www.cheekbyjowl.com/
[11] http://www.complicite.org/
[12] Boenisch, P. M., & Ostermeier, T. (2016). The Theatre of Thomas Ostermeier. Routledge.
[13] https://www.digitaltheatre.com/
যোগাযোগঃ
সৈকত চক্রবর্তী
Email: [email protected]
Facebook: https://www.facebook.com/saikat.chakraborty.942
বাংলা থিয়েটার নিয়ে একটি সময়োপযোগী লেখা। খুব ভালো লাগল।