এখনকার বাংলা সিনেমার নিরিখে যদি ভাবা যায়, অর্থাৎ বাংলা ভাষায় নির্মিত ছবি, তার যে দৃশ্যগত বা এমনকি আখ্যানগত দৃষ্টিভঙ্গি, মোস্তফা সরয়ার ফারুকী পরিচালিত ডুব ছবিটি নিঃসন্দেহে সেই গতানুগতিক পরিকল্প থেকে অনেকটাই সরে গিয়ে দর্শকদের এক নতুন অভিজ্ঞতা প্রদানে সফল। এবং সবথেকে জরুরী বিষয় হচ্ছে যে বিভিন্ন দোষত্রুটি সত্ত্বেও, ডুব ছবিটি দেখার অভিজ্ঞতা আক্ষরিক অর্থেই ‘সিনেম্যাটিক’ যা এখনকার বাংলা ছবিতে সত্যিই বিরল।
Kaahon Cinema Review: RANCHI DIARIES#KaahonCinema | #filmreview | #Bollywood | #kaahoncinemareview pic.twitter.com/fWhOF2pCqu
— kaahon (@kaahonwall) October 19, 2017
ছবির মূলে আছে জাভেদ হাসান নামের এক সফল চলচ্চিত্রকার। জনপ্রিয়তার শিখরে ও সংবাদের শিরোনামে থাকা এই মানুষটির দীর্ঘ দাম্পত্য ও পারিবারিক জীবন আচমকাই একদিন বিপন্ন হয়ে পড়ে যখন তাঁর পরবর্তী ছবির নায়িকা নীতু সংবাদমাধ্যমে তাঁদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কথা প্রকাশ করেন। শুরু হয় উত্তেজনা ও কাহিনীর মূল সংঘাত। এরপর কাহিনী ধৈর্য ধরে জাভেদের সাথে তাঁর স্ত্রী মায়া ও তাঁর পুত্র আহির এবং কন্যা সাবেরির সম্পর্কের বাঁধন আলগা হওয়াতেই বিন্যস্ত হতে থাকে। উল্লেখ্য, নীতু এবং সাবেরি শৈশবকালের বন্ধু ও সহপাঠী; ফলে, কোথাও যেন পারিবারিক সামাজিক সম্পর্কের ভাঙ্গনের তিক্ততা এক ভিন্ন মাত্রা পায়। অবশেষে, জাভেদ ও মায়ার বিবাহবিচ্ছেদের পর, তিনি নীতুকে নিয়ে নতুন সংসার পাতেন কিন্তু কিভাবে যেন তাঁর এই একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়টিও এই নবদম্পতিকে বৃহত্তর রক্ষণশীল সমাজের কাঠগড়ায় নিয়ে ফেলে।
ডুবের সম্পদ অবশ্যই তার দৃশ্যায়ন। শেখ রাজিবুল ইসলামের লং-শট এবং লং-টেকের ব্যবহারের ফলে ছবিটির চলনের যে মেজাজ ও ছন্দ তৈরি হয়, তা এককথায় অত্যন্ত তৃপ্তিদায়ক। ভিতরের দৃশ্যের মুখাবয়ব অথবা বাইরের দৃশ্যের প্রাকৃতিক বা নাগরিক ল্যান্ডস্কেপ, ক্যামেরার চলনে কখনই অহেতুক গতি ধরা পড়েনা। ক্যামেরা সর্বদাই তার সম্মুখের বাস্তবতার বিষয়ে সচেতন ও শ্রদ্ধাশীল এবং তার ফলে দর্শকও সেই দৃশ্যকল্পে মনোনিবেশ করেও পুঙ্খানুপুংখ পর্যবেক্ষণ করার আরাম উপভোগ করে। সর্বোপরি এই শৈলী সিনেমাকে টেলিভিশন গোত্রীয় মিড-শট দিয়ে ঠাসা বিরক্তিকর একমাত্রিক অভিজ্ঞতা থেকে মুক্ত করে, বড়পর্দার আবেদনের স্মৃতিকে পুনরুজ্জীবিত করতে পূর্ণমাত্রায় সফল হয়। এই প্রসঙ্গে ছবির একদম প্রথম দিকের স্কুলের হলঘরের দৃশ্য অবশ্যই উল্লেখ্য, যেখানে প্রথমবার সাবেরি ও নীতুকে পাশাপাশি দেখা যায়। স্রেফ একধরণের কম্পোজিশন এবং সামান্য কিছু ক্যামেরার চলনের সাহায্যে এই দৃশ্যটি, প্রায় বিনা বাক্যব্যায়ে, দুই বন্ধু ও তাঁদের মধ্যেক্রমশ বাড়তে থাকা দূরত্বকে অত্যন্ত সাফল্যের সাথে উপস্থাপনা করে।
ছবিটির আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক অবশ্যই তার প্রাপ্তবয়স্ক বিষয়বস্তুর প্রতি যথাযথ প্রাপ্তমনস্ক দৃষ্টিভঙ্গি। চরিত্রদের এবং তাঁদের সমস্যাকে একধরণের নৈর্ব্যক্তিক দূরত্ব থেকে লক্ষ্য করার ব্যাপারে এইছবির নির্মানগত শৈলী অনেকটাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। তবে ছবির প্রধান সমস্যার সূত্রপাতও এখানেই। প্রথম দৃশ্য থেকে শুরু করে, ধীরে ধীরে তৈরি করা এই শৈলী ক্রমশই যেন ছবির মূল বিষয়বস্তুর তুলনায় শক্তিশালী ও কর্তৃত্বপ্রয়াসী হয়ে ওঠে। গল্প ও গল্প বলা ভঙ্গিমার ভারসাম্য হারিয়ে ছবিটি বেশ খানিক দিশাহীন হয়ে পড়ে। এবং এই খামতির দায়িত্ব অবশ্যই পরিচালকের। দীর্ঘ সময় ধরে ছবিটি স্রেফ দৃশ্যগত নান্দনিকতার আত্মমগ্ন চর্চায় পরিণত হয়। শটের দৈর্ঘ অহেতুক বাড়তে থাকে, ঘটনা অকারণে অফ-স্ক্রীন পরিসরে পর্যবসিত হয় এবং প্রথম দৃশ্য থেকে তৈরি করা একধরণের সম্পাদনার কাঠামোর ফাঁদে পা দিয়ে ছবিটির নিষ্পত্তি অযথা দীর্ঘায়িত থেকে দীর্ঘায়িত হতে থাকে। অর্থাৎ, এক কথায় বলতে গেলে ছবিটি প্রধানত যে দোষে দুষ্ট, তা হল কিঞ্চিৎ অসম অসঙ্গতিপূর্ণ পরিচালনার।
সামগ্রিকভাবে ছবিটিতে অভিনয় উচ্চমানের বলাই যেত, কিন্তু সেখানে বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় কেন্দ্রীয় চরিত্রে ইরফান খানের বাংলা উচ্চারণ। আন্তর্জাতিক এই চিত্রতারকার কণ্ঠে অত্যন্ত অস্বাচ্ছ্যন্দের সাথে উচ্চারিত প্রতিটি বাংলা শব্দ শুধুমাত্র শ্রুতিকটূই হয়না, ছবিটির শ্রবণ অভিজ্ঞতাকেও রীতিমত ব্যহত করে। এই সমস্যা কিছুটা রোধ করতেই হয়তো ইরফান খানের অধিকাংশ সংলাপ ইংরাজিতে রাখা হয়; কিন্তু তাতে নাটকীয় কথোপকথানের দৃশগুলিতে সমস্যা বরং আরও বৃদ্ধি পায়। তবে সংলাপহীন মুহুর্তে ইরফানের অভিব্যক্তি ও শারীরিক ভাষা বেশ উপভোগ্য। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, ছবিটির বেশ কিছু জায়গায় শব্দগ্রহণ ও বিন্যাসের কাজ রীতিমত অপ্রত্যাশিত রকমের অপটু। ফ্ল্যাশব্যাকে থানার একটি দৃশ্যে কর্তব্যরত পুলিশকর্মীর কণ্ঠস্বরে সুস্পষ্টভাবে ব্যালেন্সের গণ্ডগোল লক্ষ্য করা যায়।
ছবির তিন মূল নারীচরিত্রে, অর্থাৎ মায়া, সাবেরি ও নীতুর ভূমিকায় যথাক্রমে রোকেয়া প্রাচী, নুসরত ইমরোজ তিশা এবং পার্ণো মিত্রের কাজ নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। কিন্তু প্রধানত চিত্রনাট্য এবং পরিচালনার কিছু দূর্বলতা এবং ঘাটতির কারণে, মূল আখ্যানেই যেন এই চরিত্রগুলির প্রতি যথাযথ সুবিচার করা হয়না। অর্থাৎ যেই পরিণত দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ছবিটি এই চরিত্রগুলিকে শুরুতে উপস্থাপনা করে, মাঝপথে কোথাও যেন সেই চরিত্রাঙ্কন খুবই গতানুগতিক ও বাঁধাধরা প্রচলিত ধারণার ফাঁদে পড়ে যায়। চারিত্রিক জটিলতার পরিবর্তে প্রথম স্ত্রী ও কন্যার প্রতি পক্ষপাতের প্রবণতা তৈরি হয়। এবং একধরণের রক্ষণশীল সমাজব্যবস্থা কিভাবে জাভেদের কন্যাসম দ্বিতীয় স্ত্রীর ব্যাপারে সাবেকি নৈতিকতার ধ্বজাধারী হয়ে ওঠে, ছবিটি সেই মতাদর্শ থেকে সমালোচনামূলক দূরত্ব বজায় রাখতে অসফল হয়ে পড়ে। একটি জটিল আখ্যানের প্রতিশ্রুতিময় উপক্রমণিকা নিতান্তই সাদা-কালো নৈতিকতার উপসংহারে গিয়ে শেষ হয়।
পরিশেষে ছবিটির মূল্যায়নে হয়তো দুটি কথা প্রযোজ্য। ডুব তার দৃশ্যগত নির্মাণশৈলীর জন্য অবশ্যই সাম্প্রতিককালের বাংলা ছবির মধ্যে স্মরণীয় হয়ে থাকার যোগ্য। বাংলা ছবিতে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত বা লুপ্তপ্রায় একধরণের বিলম্বিত ছন্দ এবং নৈশব্দের অভিজ্ঞতাকে পর্দায় নিয়ে আসার কারণে এই ছবিটি অবশ্যই প্রশংসার দাবী রাখে। কিন্তু একইসাথে,ঢাকা শহরের কিছু মানুষের জীবন নিয়ে একটি সিনেম্যাটিক আখ্যান রচনা করতে ষাট-সত্তরের দশকের ইউরোপীয় আর্ট-সিনেমা থেকে ধার করা একটি শৈলী বা ভাষার প্রয়োজন কেন; এই প্রশ্নও প্রাসঙ্গিক থেকেই যায়।